জাতীয় পার্টি আর কত নাটক করবে?
- আপডেট সময় : ০৫:২১:০৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ৩০৭ বার পড়া হয়েছে
জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতো জাতীয় পার্টিরও উপযোগিতা আছে আমাদের কাছে, যেটা বাংলাদেশের কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না। কী সেই উপযোগিতা? —বিনোদন, অতি উৎকৃষ্ট রাজনৈতিক বিনোদন তথা হাস্যরস।
এরশাদ নিজে ছিলেন স্বৈরাচারী সামরিক শাসক, সারাদেশ নানা জোটে বিভক্ত হয়ে আন্দোলন করছে তাকে হটানোর জন্য। সেই অবস্থার মধ্যেও তার কর্মকাণ্ড আমাদের ক্রমাগত জুগিয়ে যেত রাজনৈতিক হাস্য-রসাত্মক বিনোদন। এরশাদের কোনোপ্রকার নীতি নৈতিকতা যেমন ছিল না সেইরকম সিদ্ধান্তহীনতা ছিল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেও।
সামরিক শাসন জারি করে তিনি ক্ষমতা দখল করেন, সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদ দখল করার আগে তার পদবী ছিল প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা ইংরেজিতে Chief Martial Law Administrator বা সংক্ষেপে CMLA বা সিএমএলএ। এই সংক্ষিপ্ত রূপ সিএমএলএ কথাটাই তখন সবাই ঠাট্টা করে বলতো সিএমএলএ মানে হচ্ছে ক্যান্সেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট। কেননা সামরিক শাসক হিসেবে নিয়মিত যেসব আদেশ তিনি দিতেন দেখা যেত, দিন শেষ না হতেই তা আবার বদলে দিচ্ছেন।
এরশাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আর তার পরিবারের জন্য অন্যান্য ত্যাজ্য বিত্তের সাথে একটা সম্পদ রেখে গেছেন তা হচ্ছে জাতীয় পার্টি। ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর জাতীয় পার্টি থেকে কিছু নেতা বেরিয়ে গিয়ে নিজেদের আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করে। তবে জাতীয় পার্টির বড় অংশটি অথবা বলতে পারেন মূল অংশটি এরশাদের দখলেই ছিল যেটা তিনি রেখে গেছেন তার সন্তান, ভাই ও স্ত্রীদের জন্য।
এই পার্টিটাও ঐ এরশাদের মতোই একটা রাজনৈতিক হাস্য বিনোদনের অফুরান উৎসে পরিণত হয়েছে। এই পার্টির মালিকানা নিয়ে এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ, এরশাদের ভাই জি এম কাদের এই দুজনের মধ্যে টানাটানি একটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এর সাথে মাঝে মাঝে যুক্ত হয়েছে এরশাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং কনিষ্ঠ স্ত্রী।
শেষের দুইজন নিয়মিত না হলেও মাঝে মাঝেই জনসমক্ষে আবির্ভূত হয়ে নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন নানাপ্রকার কৌতুককর দাবিতে। আর মালিকানা নিয়ে এইরকম টানাহেঁচড়ার সমাধানের জন্যে জাতীয় পার্টির এই দুই বড় উত্তরসূরি, এরা গিয়ে ধরনা দেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে—তিনি যা নির্দেশ দেবেন সেই অনুযায়ীই নাকি এরা কাজ করবেন।
ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর জাতীয় পার্টি থেকে কিছু নেতা বেরিয়ে গিয়ে নিজেদের আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করে। তবে জাতীয় পার্টির বড় অংশটি অথবা বলতে পারেন মূল অংশটি এরশাদের দখলেই ছিল যেটা তিনি রেখে গেছেন তার সন্তান, ভাই ও স্ত্রীদের জন্য।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকল। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিলো বটে, কিন্তু নির্বাচনে গেল মূলত আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া ছাব্বিশটা আসনে জেতার লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু আফসোস, এই ছাব্বিশটা আসনেও ওদের প্রার্থীরা জিতে আসতে পারল না।
সর্বসাকুল্যে এগারোটা আসনে জিতে এসেছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে আগেই জাতীয় পার্টির মালিকানার দুই উত্তরসূরি রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে বিভেদ আবার সামনে চলে আসে। জি এম কাদের দলটি নিজের দখলে নিয়ে নেন, রওশন এরশাদ ও এরশাদের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে নির্বাচনের বাইরে রেখে তিনি নিজের জন্যে ও নিজের স্ত্রীর জন্যে দুইটা আসনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় নেন।
নিজের আসনটা জিতে আসতে পারলেও তার স্ত্রীকে জিতিয়ে আনতে পারেননি। জি এম কাদের নিজে ও অন্য দশজন এই এগারোটা আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি যখন সংসদে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে, তখন জাতীয় পার্টির একদল নেতা গিয়ে এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের কাছে হাজির হন—এরা জাতীয় পার্টি থেকে জি এম কাদের ও কাদেরের মহাসচিবকে বহিষ্কার করতে চান।
এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয় মূলত জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি যখন ছাব্বিশটি আসনে ছাড় নিয়ে এই কয়েকটা আসনে নিশ্চিত বিজয়ের প্রত্যাশায় নির্বাচনে যায় তখন থেকেই। নির্বাচনের সময়টায় দলের লোকজন চুপচাপ থেকেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন অনেকগুলো আসনে। যদিও কয়েকটা আসনে ওদের প্রার্থীরা ভোটের তারিখের আগেই ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দাঁড়িয়েছেন তথাপি খুব বেশি নেতা কর্মী তখন মুখ খোলেননি।
অনুমান করি ওদের মনে তখনো প্রত্যাশা ছিল যে আগেরবারের মতো দল যদি সরকারের সাথে থাকে তাহলে হালুয়া-রুটির ভাগ কিছুটা হলেও ওরা পাবে। কিন্তু নির্বাচনের পর যখন দেখা গেল যে ওরা আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া ছাব্বিশটা আসনের সব কয়টাও ধরে রাখতে পারেনি এবং আওয়ামী লীগও জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতার অংশ করতে খুব একটা আগ্রহী নয় তখনই ওদের নেতারা একে একে মুখ খুলতে শুরু করে এবং অভিযোগ করতে থাকে যে পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও তার মহাসচিব চুন্নু মিলে সরকারের কাছ থেকে টাকা খেয়ে ওদের বিকিয়ে দিয়েছে ইত্যাদি। দলের অনেকেই দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দেয়।
এরই ফলশ্রুতিতে একদল নেতা গিয়ে রওশন এরশাদের দ্বারস্থ হয়, রওশন নিজেকে পার্টির চেয়ারম্যান দাবি করে কাদের ও চুন্নুকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়। ফলত আরেকবার ভেঙে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি—রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি আগামী কিছুদিনের মধ্যে দলের কাউন্সিল করার ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে ওদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির স্বীকৃতির জন্যে।
দেশের জনগণের মধ্যে যে অংশটি আওয়ামী লীগকে অপছন্দ করে, তাদের কাছে জাতীয় পার্টি হতে পারত বিএনপির একটি বিকল্প…..
এর মধ্যে সংসদে জি এম কাদেরকে নির্বাচন করা হয়েছে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আর উপ-নেতা হয়েছেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।
এর মধ্যে রাজনৈতিক মহলে একটা কথা উঠেছিল যে এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টির সামনে এখন সুযোগ এসেছে নিজেদের প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। এগারো জন্য সদস্য নিয়েই বিরোধী দলের আসনে বসে যদি ওরা নিজেদের একটি যথাযথ সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রমাণ করতে পারত তাইলে হয়তো ওরা একটা গ্রহণযোগ্য নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জনগণের সামনে হাজির হতে পারত।
দেশের জনগণের মধ্যে যে অংশটি প্রথাগতভাবেই একটু ইসলাম পছন্দ করে অথচ মৌলবাদী নয় এবং আওয়ামী লীগকে অপছন্দ করে, তাদের কাছে জাতীয় পার্টি হতে পারত বিএনপির একটি বিকল্প। কিন্তু জাতীয় পার্টি যে ধাতুতে তৈরি সেই বৈশিষ্ট্য যাবে কোথায়!
জনগণের পক্ষে থাকবে, সংগঠিত একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করবে, গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলবে সেই ধাতুতে কি আর জাতীয় পার্টি তৈরি হয়েছে? হয়নি। এই দলটি তৈরিই হয়েছে হালুয়া-রুটির লোভে এসে জড়ো হওয়া কিছু লোককে নিয়ে, যারা এরশাদকে প্রভু মেনেছিল। রওশন এরশাদ ওদের প্রভুপত্নী আর জি এম কাদের হচ্ছে ওদের ভাই-প্রভু। এরা কী করে একটি যথাযথভাবে গঠিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করবে?
জাতীয় পার্টি আমাদের দেশের রাজনীতিতে স্বৈরাচারের পদচিহ্ন বা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেই বিরাজ করবে আরও কিছু বছর। দেশে গণতান্ত্রিক সংকট তাদের অস্তিত্বকে হয়তো কিছুটা প্রলম্বিত করবে—কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এরা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর যতদিন টিকে থাকবে ততদিন এরা ওদের মূল মালিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতোই আমাদের সবার জন্য বিরক্তি এবং একই সাথে ক্রমাগত হাস্যরসের জোগান দিয়ে যাবে।