নলছিটিতে চাঞ্চল্যকর ফুয়াদ কাজী হত্যার রহস্য
স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ফুয়াদ কাজী হত্যা, ইউপি চেয়ারম্যান জেসমিনের বাড়িতে হয় গোপন বৈঠক
- আপডেট সময় : ১১:০২:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ এপ্রিল ২০২৪ ২৫২ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক— নলছিটিতে আলোচিত স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জিয়াউল হাসান ফুয়াদ কাজী (৪০) হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিদ্ধকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী জেসমিন আক্তার। হত্যাকাণ্ডের আগে ইউপি চেয়ারম্যানের চৌদ্দবুড়িয়া গ্রামের বাসায় বসানো হয় গোপন বৈঠক। ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ওই বৈঠকে অংশ নেন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা। এতে উপস্থিত ছিলেন জেসমিন আক্তার। প্রথমে তাঁরা ফুয়াদ কাজীকে হাত ও পা কেটে পঙ্গু করার পরিকল্পনা করেন। কাজী জেসমিন আক্তারকে গ্রেপ্তারের পর শনিবার বিকেলে ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারকি এএইচএম ইমরানুর রহমানের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদানকালে তিনি এসব কথা বলেন। তবে শোনা যায়, ফুয়াদ কাজী হত্যাকাণ্ডের আগে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে কাজী জেসমিনের বাসায়। এছাড়াও হত্যাকারীরা বিভিন্ন স্থানে বৈঠক করে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পুলিশ ইতোমধ্যে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলামসহ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ নানা তথ্য পায়। এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেত্রী কাজী জেসমিন আক্তারকে। হত্যাকাণ্ডে আরো যারা জড়িত রয়েছে পুলিশ তাদের চিহ্নিত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করবে বলে জানিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নলছিটি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) তানজিলুর রহমান। গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের বিজয় মিছিল শেষে রাতে বাড়ি ফেরার পথে উপজেলার সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের চেদ্দবুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ও ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি জিয়াউল হাসান ফুয়াদ কাজীকে বাড়ির সামনে চৌদ্দবুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই ফয়সাল হোসেন কাজী বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে নলছিটি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে সিদ্ধকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী জেসমিন আক্তারকে (৪৮) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শুক্রবার রাতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. মহিতুল ইসলামের নেতৃত্ব পুলিশের একটি দল উপজেলার সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের চৌদ্দবুড়িয়া নিজ বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। একাধিক সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তার হওয়া কাজী জেসমিন আক্তার সিদ্ধকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের দুই বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। ওই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ওবায়েদ কাজীর মৃত্যুর পর তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নিহত কাজী জিয়াউল ইসলাম ফুয়াদ এক সময়ে তাঁর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিল। ফুয়াদ কাজীকে দিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান যাকে ইচ্ছে তাকে লাঞ্ছিত করাতেন। এমনকি ইউপি চেয়ারম্যানের কথা না শুনলে নানা ধরণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ছিল ফুয়াদ কাজীর বিরুদ্ধে। এরই জের ধরে ফুয়াদ কাজীর সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয় সিদ্ধকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। রফিকুল ইসলামকে ফুয়াদ কাজী কয়েক দফায় মারধরও করেন। এমনকি ফুয়াদের ভয়ে দীর্ঘদিন ইউনিয়ন পরিষদের আসতে পারেনি ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম। এতে রফিকের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ফুয়াদ কাজীর সঙ্গে ইউপি চেয়ারম্যান কাজী জেসমিন আক্তারের বিরোধ হয়। ফুয়াদ কাজী তাঁর অফিসে টানানো ইউপি চেয়ারম্যানের ছবি ভেঙে ফেলেন। এর পরে দ্বন্দ্ব আরো প্রকাশ্যে রূপ নেয়। ফুয়াদ কাজী ইউপি চেয়ারম্যানকে নিয়ে কটুক্তি, গালাগাল ও হুমকি ধমকি দেওয়া শুরু করেন। এমনকি আগামী ইউপি নির্বাচনে ফুয়াদ চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন। এসব ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান কাছে ডেকে নেন ফুয়াদের দ্বারা নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত ব্যক্তিদের। এর মধ্যে ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলামকে দিয়ে ফুয়াদকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা আটেন জেসমিন আক্তার। শত্রুতা শেষ করতে রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একাধিকবার জেসমিন আক্তারের বাসায় ফুয়াদকে মারার পরিকল্পনা করা হয়। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পরে ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন আদালতে। তিনি জেসমিন আক্তারের বাসায় বৈঠকের কথা স্বীকার করেন। পুলিশ মোবাইল ফোন ট্রাকিং ও নানা মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ইউপি চেয়ারম্যান জেসমিন আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলার বাদী ফয়সাল হোসেন কাজী বলেন, আমার ভাইয়ের সঙ্গে জেসমিন আক্তারের বিরোধ ছিল। আমার ছোট ভাইকে হত্যার পরিকল্পনাকারী ইউপি চেয়ারম্যান কাজী জেসমিন আক্তার। তাঁর পরিকল্পনায় গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা আমার ভাইকে হত্যা করে। আমি এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নলছিটি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) তানজিলুর রহমান বলেন, আমরা মামলাটি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তকর্তারাও এটা নিয়ে ঘেটেছেন। সকলের প্রচেষ্টায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছ। আরো যারা বাইরে আছেন, তাদেরকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। যারা ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা কোন না কোনভাবে স্বীকার করেছেন। ঝালকাঠির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. মহিতুল ইসলাম বলেন, জিয়াউল আহসান ফুয়াদ কাজী হত্যার ঘটনায় ইতোপূর্বে গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে কাজী জেসমিন আক্তারের নাম উঠে এসেছে। এ হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় নিজ বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তিনি নিজেই হত্যার পরিকল্পনার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।